Total Visitor
Website counter
Counting since March 26, 2008

Success Story of Member

Client Image

শাখার নাম : কোরণীগঞ্জ শাখা, ঢাকা
কোড নং : ৩৩
মুক্তিযুদ্ধে পিতা ও বড় ভাইকে হারানো আমাকে বেঁচে থাকার যুদ্ধে সারথি হয়েছে ডিএমসিবি


৭১ এ পিতা ও বড় ভাইকে হারিয়ে অভিভাবকহীন মোঃ আব্দুল হালিম কীভাবে নিজ পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন, কীভাবে নিঃস্ব হয়ে মাটিতে মিশে যাওয়া অবস্থা থেকে উঠে আজ সফল ও সাবলম্বী ব্যবসায়ী হয়েছেন, নিজ পরিবার ও ভাই বোনদেরকে বিয়ে দেওয়া সহ ভাইদের প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই গল্প শুনুন তার নিজের মুখে।

পাকিস্তানী হানাদার বািহনীর পুড়িয়ে দেওয়া পিতৃ ভূমিতেই এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একটি দ্বিতল ও একটি চার তলা বাড়ী। খুব মনে আছে সেদিন খুব কেঁদেছিলাম, সেই ছোট্ট বয়সে। কতই বা আর বয়স হবে এগার কী বার বছর। সেই বয়সেই প্রিয় পিতা, বড় ভাই, দুই চাচা, দুই চাচী ও বাড়ির কাজের লোকসহ ৭ জনের লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিলাম আমাদের ভষ্মিভূত বাড়ীর উঠানে। আজও আমাকে সেই স্মৃতি কুরে কুরে খায়। সে দৃশ্য কী যে যন্ত্রণাদায়ক তা বলে বোঝাতে পারব না। আগেই সংবাদ পেয়েছিলাম যে, হানাদার বাহিনী ও তার দোসররা মুক্তি সেনাদের খুঁজতে বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে আমাদের গ্রাম, ঢাকা জেলার কোরাণীগঞ্জ থানার জিঞ্জিরা ইউনিয়নের বন্ধডাক পাড়া’র দিকে ধেঁয়ে আসছে। এ সংবাদ আমার বাবা-চাচাদের কানে পৌঁছানো মাত্র লোক মারফত সংবাদ পৌঁছায়; মা যেন আমাদের ৪ ভাই ও ৩ বোনকে নিয়ে বাড়ী ছেড়ে নিরাপদ কোন অঞ্চলে চলে যায়। মা বাবা চাচাদের কথা মতো সেদিন চলে গেলেও আমার বড় ভাই স্কুলে থাকার কারণে তাঁর কাছে সংবাদ পৌঁছান সম্ভব হয়নি। তাই সে স্কুল শেষে বাড়ী ফিরে অপেক্ষা করতে থাকে। বাবা তাঁর কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা বাজারের আটা পট্টির খুদ-কুড়া-ভুষির দোকান ছেড়ে বাড়ীতে এসে আমার বড় ভাইকে নিয়ে বাড়ীর পাশের অঞ্চলে চলে যেতে মনস্থির করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি, বাড়ী ছেড়ে যাওয়ার আগেই হানাদার ও তার দোসররা আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমার পিতা, বড় ভাই সহ আমার চাচা-চাচী মিলিয়ে মোট ৭ জনকে গুলি করে মেরে বাড়ীর উঠানেই ফেলে রাখে, আর পুরো বাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর দুদিন পর আমরা বাড়ীতে ফিরে দেখতে পাই উঠানে পড়ে থাকা লাশগুলো পঁচতে শুরু করেছে। সমগ্র গ্রাম তখন মৃত্যুপুরীতে পরিণিত হয়েছে। আমরা মা, ছোট ভাই-বোনরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। শোকের কাতরে কাঁদতে ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন, কারণ দু’দিনের নির্ঘূম রাত, পথের ক্লান্তি আর সেই সাথে পেটে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে আমরা একরকম বিধ্বস্ত ছিলাম।

মা আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে প্রাণ বাঁচাতে পদ্মা নদীর চরাঞ্চলে চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফিরে এসে দেখি আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। তখন আমাদের পরিবারের আর কোন অভিভাবক বেঁচে নেই। অগত্যা আমার মা আমাদের ভাই-বোনদের নিয়ে আমার নানার বাড়িতে চলে গেলেন। নানার বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল হওয়াতে নানা আমাদের আগলে রাখলেন। নানার বাড়িতে মা সহ আমাদের ৬ ভাই-বোন থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো। বাবার ব্যবসাটি বন্ধ হওয়ার উপক্রম দেখে আমার নানা সেই দোকানে বসতে শুরু করলেন। আমরা পড়াশোনাও শুরু করলাম। আমি তখন ৮ম শ্রেণী পাশ করেছি, নানারও তখন যথেষ্ট বয়েস হয়েছে তাই নানা আমার বাবার রেখে যাওয়া ব্যবসাটি আর চালিয়ে যেতে পারছিলেন না। অগত্যা আমাকে পড়াশোনায় ইস্তফা দিতেই হলো। এরপর মা ও নানার সাথে যুক্তি করে জিঞ্জিরা বাজারের আটা পট্টিতে আমার বাবার দোকানটিতে আমি বসতে শুরু করলাম। আমার বয়স তখন বড় জোর ১৭/১৮ বছর।

সময়টা ১৯৭৮-১৯৭৯ হবে, দোকানে তো বসতে শুরু করলাম, কিন্তু কিছু দিন যেতেই বুঝতে পারলাম যে খুদ-কুড়া-ভূষির ব্যবসা ভালো মতো চালাতে গেলে আরো অনেক পুঁজি প্রয়োজন। কথাটি আমি আমার মা ও নানার কাছে জানালাম। নানা সব শুনে আমাকে ব্যবসার জন্য ৫০ হাজার টাকার পুঁজি প্রদান করলেন। সেই টাকা দিয়ে আমি নতুন করে আমার দোকানে মালামাল তুললাম। ইতোমধ্যে দোকানের মালিক দোকানের চুক্তির মেয়াদান্তে নতুন করে চুক্তি করতে বললেন। এতো দিন দোকানের কোন অগ্রীম ছিল না, শুধু ভাড়া দিতে হতো। তবে এবার অগ্রীম হিসেবে ১০ হাজার টাকা নিল সাথে ভাড়া নির্ধারণ হলো ২০০ টাকা। ভাড়া কিছুটা কমলেও অগ্রীম হিসেবে বেশ অনেক টাকা চলে যাওয়াতে আমার ব্যবসাতে বেশ সাময়িক একটা ধাক্কা লাগল। আমি মাত্র বছর খানেক বসার পরই এই চুক্তি হওয়াতে বেশ একটু বেকায়দাই পড়লাম। তবুও কিছু মনে করিনি কারণ, এটি আমার কাছে শুধু ব্যবসাই নয় বরং এটি আমার বাবার স্মৃতি ও পেশাকে সম্মান জানানোও বটে।

এভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই আমার ব্যবসা ডানা মেলতে শুরু করল। সাফল্য ধরা দিতে লাগল হাতের মুঠোই। আমি আমার জীবনে ব্যবসা হতে অর্জিত অভিজ্ঞতা পরবর্তী দিনগুলোতে কাজে লাগিয়ে বাস্তাব জীবনে ব্যবসা হতে দারুণ ভাবে লাভবান হয়েছি। তাছাড়া আমি আমার পরিবারকে কখনেই দূরে ঠেলে ফেলিনি। বরং সংসারে বড় ও অভিভাবক হিসেবে প্রতিটি মুহুর্তে আমি আমার পরিবারকে আগলে রেখেছি। তবে আমার ছোট দুটি ভাই আর তিনটি বোনের পড়াশোনা এবং তাদের বিয়ে-সাদী দিতে গিয়ে আমি তেমন কোন স্থাবর সম্পতি করতে পারিনি। তাছাড়া ১৯৮৬ সালে আমি নিজেও বিয়ে করি। এদিকে যত দিন যেতে থাকল ব্যবসা করাটা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়াল। কারণ এই ব্যবসায় প্রচুর পুঁজি প্রয়োজন। তবে আমি কখনও ব্যাংক হতে ঋণ নিতাম না কারণ ব্যাংক হতে ঋণ নেওয়াটা আমার কাছে বেশ ঝামেলার মনে হতো। তবে ১৯৯৫ সালের দিক হতে আমি একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান হতে খুব অল্প পরিসরে ঋণ নিতে শুরু করি। বিশেষ করে আমার এই ব্যবসায় যখন মৌসুম আসে তখন এককালীন অনেক টাকা প্রয়োজন হয়। তাই বাধ্য হয়ে আমি ঐ সমবায় হতে বিনিয়োগ নিতাম।

এর মধ্যে একদিন আমার দোকানে মোহাম্মদ আলম হোসেন নামে এক ব্যক্তি আসলেন, সালাম দিলেন এবং পরিচয়ে বললেন যে তিনি “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড” (ডিএমসিবি) এর কেরানীগঞ্জ শাখার একজন সিনিয়র বিনিয়োগ কর্মকর্তা। তিনি আমাকে বললেন যে, তার সমবায় ব্যাংক সৎ, কর্মঠ ও পরিশ্রমী ব্যবসায়ী যাদের প্রতিদিনের বেঁচা-কেনা আছে এমন ব্যবসায়ীদের খুব সহজ শর্তে বিনিয়োগ প্রদান করে থাকে। শুনে আমি আগ্রহ দেখালাম না। কারণ আমি তখন একটি সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকে মাঝে মাঝে বিনিয়োগ নিতাম। তবে তিনি যাওয়ার আগে অফিসে আসার জন্য দাওয়াত দিয়ে গেলেন। ঠিকানা শুনে চিনলাম, কারণ ঐ মার্কেটে ব্যবসায়িক কারণে মাঝে-মাঝে আমাকে যেতে হয়।

এরপর প্রায় বছর খানেক পর একদিন হঠাৎ আমার কিছু টাকার প্রয়োজন হয়। আমি যে সমবায় প্রতিষ্ঠান থেকে বিনিয়োগ নিতাম সেখানে তাদের অফিসিয়াল জটিলতার কারণে বিনিয়োগ পেতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু আমার জরুরী টাকার প্রয়োজন। কী করব তা ভাবছি এর মধ্যে হঠাৎ আমার মনে পড়ল ডিএমসিবি’র কথা। আরো মনে পড়ল তাদের অল্প সময়ে বিনিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থার কথা। ব্যস্, আর দেরী না করে চলে গেলাম ডিএমসিবি’র কেরানীগঞ্জ শাখায়। শাখাতে গিয়ে ব্যবস্থাপক সাহেবের সাথে দেখা করে আমার প্রয়োজনের কথা বললাম। আমি অবাক হয়ে গেলাম, যখন আমি আমার পরিচয় দিলাম তখন ব্যবস্থাপক সাহেব আমাকে চিনলেন। শুধু চিনলেনই না আমার যে জিঞ্জিরা বাজারে ব্যবসায়ী মহলে একটা সম্মান আছে তিনি তাও জানেন। আমি রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে গেলাম। শুধু তাই নয় আমার মুগ্ধতা তখনও বাকী ছিল। আমি সব কিছু বলার পর আমাকে সদস্য করে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে প্রথমবার ১ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ প্রদান করলেন। ২০০৮ সালের সেই দিন থেকে আমার সম্পর্ক শুরু হলো ডিএমসিবি’র সাথে। এরপর বহু বার প্রয়োজনের সময় ডিএমসিবিকে আমি আমার সাথে পেয়েছি। এখন পর্যন্ত আমি ডিএমসিবি থেকে মোট ২২ বার বিনিয়োগ নিয়েছি। বর্তমানে আমার চলমান বিনিয়োগটি ১০ লক্ষ টাকার। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি টাকাও আমি বিনিয়োগ নেই না এবং বিনিয়োগ নিয়ে পরিকল্পনা মাফিক সেই বিনিয়োগ আমি আমার ব্যবসায় কাজে লাগিয়েছি। ডিএমসিবি’র সাথে সম্পর্ক হওয়ার পর আমি অন্য সমবায় প্রতিষ্ঠানটির সাথে আমার সকল লেনদেন বন্ধ করে দিয়েছি।

আমার ব্যবসায়িক অবস্থা আলহামদুলিল্লাহ বেশ ভালো। বর্তমানে আমি ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা মূল্যের ব্যবসা পরিচালনা করছি। আমার এই দোকানটির সাথে আরো দুটি গোডাউন নিয়েছি। যার প্রতিটির অগ্রীম ২ লক্ষ টাকা এবং ভাড়া যথাক্রমে ৫ হাজার ও ৭ হাজার টাকা। আমার এই দোকানটির অগ্রীম ৫ লক্ষ টাকা আর ভাড়া ১৫ হাজার টাকা। তাছাড়া বর্তমানে আমার বেশ কিছু টাকাও জমা হয়েছে। এখন পুরো পরিবার নিয়ে আমি সহ আমার ভাইরাও তাঁদের সংসারে সুখে শান্তিতে বসবাস করছেন। ভবিষ্যতে হজ্বে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছি। আমার সংসারে ২টি ছেলে ও ১টি মেয়ে সন্তান আছে। বড় ছেলে ও মেয়েটিকে বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলে এখনও বিয়ে করেনি। আমার বড় ছেলে আমাকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সাহায্য করে আর ছোট ছেলে পড়াশোনা শেষ করে বর্তমানে ঢাকার চক বাজারে একটি দোকান নিয়ে চায়না কসমেটিক্স ও খেলনা আইটেমের পাইকারী ব্যবসা করছে।

ইতোপূর্বে ব্যবসার লাভের টাকা দিয়ে পাকিস্তানী হানাদারদের আগুনে পুড়ে যাওয়া আমার পৈত্রিক ভিটাতে ছোট দুই ভাইয়ের জন্য ১২ রুমের দুই ইউনিটের একটি দুই তলা বাড়ী করে দিয়েছি। নিজের জন্য একই জমিতে একটি ৪ তলা বাড়ী করেছি। এই বাড়ী গুলো শুধু আমার কাছে বাড়ীই না। এগুলো আমার কাছে ৪৯ বছর আগের পাওয়া দুঃখ ভোলার একটা ক্ষুদ্র মন্ত্রও বটে। আজও মনে পড়ে ৭১ সালে যেমন বাবা-ভাইয়ের রক্ত মাখা লাশ দেখে তাদের জন্য কেঁদেছি, ঠিক তেমনি কেঁদেছি যখন দেখেছি নিজেদের মাথা গোঁজার জন্য একমাত্র আশ্রয়স্থলটি পুড়ে মাটিতে ছাই হয়ে পড়ে আছে। তাই ঐ ১১-১২ বছর বয়সে বাবা হারানোর যে কষ্ঠ তা আমাকে যতটা না কাঁদিয়েছিল তার চেয়ে বেশী কাঁদিয়েছিল আশ্রয়হীনতার কারণ। তাই যখন আমি আমার ব্যবসা হতে টাকা জমিয়ে সেই পোড়া পিতৃ ভূমিতে নিজের ও ছোট ভাইদের জন্য বাড়ী করতে পেরেছি তখন মনের অজান্তে একটা দীর্ঘ স্বস্তির নিঃস্বাস বেরিয়ে এসেছিল। পরিশেষে বলতে চাই, আমার এ সফলতার জন্য আমি সর্বদা যে প্রতিষ্ঠানটিকে পাশে পেয়েছি সে হচ্ছে ডিএমসিবি। এ প্রতিষ্ঠানটির নিকট আমি চির কৃতজ্ঞ। আমি প্রতিষ্ঠানটির সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি।