Total Visitor
Website counter
Counting since March 26, 2008

Success Story of Member

Client Image

শাখার নাম : এয়ারপোর্ট শাখা, ঢাকা
কোড নং : ১০
ডিএমসিবি'র সহায়তায় স্বামী পরিত্যক্তা, অসহায় নারী নার্গিস আক্তার এখন প্রতিষ্ঠিত সফল ব্যবসায়ী


স্বামী পরিত্যক্তা অসহায় নারী নার্গিস আক্তার "দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড" (ডিএমসিবি) এর সহায়তায় কিভাবে প্রতিষ্ঠিত সফল ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়েছেন তার সফলতার কাহিনী শুনুন নার্গিস আক্তারের কাছ থেকে। "আমি নার্গিস আক্তার, কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদী উপজেলার বনগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান এর মেয়ে। পড়ালেখাতে ছিল আমার দারুণ আগ্রহ। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলাম। বাবা তাই বলেছিলেন আমি যতদূর পড়তে চাই ততদূরই পড়াবেন। বাবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমাদের পারিবারের আর্থিক অবস্থা ছিল যথেষ্ট স্বচ্ছল। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় আমার ফুফুর ঢাকার আশকোনার বাসার গৃহশিক্ষকের সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে ফুফুর প্রোরোচণায় পরিবারের অমতে বিয়ে করি ঐ গৃহ শিক্ষককে। আমার স্বামী আমার থেকে প্রায় ১৫ বছরের বড়। আমাদের এ বিয়েকে মেনে নেয়নি আমার পরিবার। ফলে স্বামীকে নিয়ে ঢাকার দক্ষিণ খানের কাউলা বাজারের পাশ্বে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে শুরু হলো আমার সংসার। শুধু সংসারই শুরু হলো না সাথে শুরু হলো জীবনের সবচেয়ে কঠিন যুদ্ধ; বেঁচে থাকার যুদ্ধ; না খেয়ে থাকার যুদ্ধ। স্বামীর আসল রূপটা তখনই ধরে ফেললাম, সে ছিল আসলে একজন প্রতারক। বিয়ের আগে সে বলেছিল সে বি,এ পাশ, বাংলাদেশ বিমানে চাকুরী করে। বাস্তবে সে পড়ালেখা করেছে মাত্র এসএসসি পর্যন্ত। আর বাংলাদেশ বিমানে চাকুরির কথাটাও ছিল মিথ্যা। স্বামীর এই সব তথ্য আমার ফুফু জানলেও আমাকে তা জানায়নি। যখন সত্যটা জানলাম ভেঙে মুষড়ে পড়লাম। তবু সাহস হারালাম না। স্বামী বাসায় শুয়ে বসে থাকে। অগত্যা আমি ফুফার পরিচিত একজনের মাধ্যমে অনেক চেষ্টায় গার্মেন্টস এ একটা চাকুরি নিলাম। কিন্তু সে চাকুরি বেশী দিন করতে পারলাম না, কারণ ডিউটিরত অবস্থায় একদিন মাথা ঘুরে পড়ে গেলাম। দীর্ঘ দিন না খেতে পেয়ে শরীরে দেখা দিয়েছিল রক্ত শুণ্যতা। এরপর বাসায় কিছুদিন থাকার পর আবার চাকুরি খুঁজতে শুরু করলাম অনেকটা একাই। নিজের গহনা বিক্রি করে পরিচিত এক আঙ্কেলকে দিয়ে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করতে অনুরোধ করি। তিনিও সেই গহনা বিক্রির টাকাটা মেরে দেন।

এর মধ্যে আমার একটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। সেই সাথে অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও চালিয়ে যাওয়া পড়ালেখার একটা স্বীকৃতি পেলাম এসএসসি পাশের মাধ্যমে। তারপর অনেকটা নিজের প্রচেষ্টায় সিদ্ধেশ্বরী রোডে একটি টিভি কোম্পানিতে চাকুরি পাই, বেতন ১ হাজার ২৫০ টাকা। চাকুরিতে পারদর্শীতা স্বরুপ কিছুদিনের মধ্যে পদোন্নতি হলো সাধারণ কর্মী থেকে হয়ে গেলাম এসেম্বলার। সংসারে ভাতের কষ্ট কমলেও স্বামী দিনে দিনে আরো বেশী উদাসীন হয়ে যেতে থাকে সংসারের প্রতি। আমার বিষয়ে সে এতোটাই অবহেলা করতো যে, আমি প্রায়ই ডিউটি শেষ করে বাসায় ফিরতে রাত্র ১১-১২টা বেজে গেলেও বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাকে আনতে পর্যন্ত যেত না। এত রাতে দূর্গম এ পথে প্রায়ই আমাকে একা ফিরতে হতো। তাতে তাঁর কোন ভ্রুক্ষেপ ছিল না। বরং ততদিনে সে আমাকে বিভিন্ন ভাবে দোষারোপ করতে শুরু করে। নিজের অপরাধ ঢাকতে সে প্রতিনিয়ত আমার উপর অত্যাচার করতে থাকে। একপর্যায়ে টিভি কোম্পানির চাকুরিটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম। ২০০৫ সালে যখন চাকুরিটা ছাড়ি তখন আমার চাকুরির বয়স হয়েগেছে ১০ বছর, বেতন পাই ১৩ হাজার ৮ শত টাকা। এরপর কাউলা বাজারে নিজের এতো দিনের জমানো কিছু টাকা দিয়ে ২০০৬ সালে একটি ইলেকট্রিক মালামালের দোকান দেই। প্রথম দিকে ব্যবসা জমে গেলেও পরে স্বামীর স্বেচ্ছাচারিতা ও চরম অবহেলার শিকার হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে ব্যবসাটি। ফলে বাধ্য হয়ে ঐ ব্যবসা বন্ধ করে দিই।

এরমধ্যে আমার স্বামী মাঝে মধ্যেই আমাকে ছেড়ে চলে যেত, কিছুদিন পর আবার ফিরে আসতো। এক পর্যায়ে বাবার বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে আসি। সেই টাকা দিয়ে একটি সেলাই মেশিন কিনে কাউলা বাজারের একটি লেডিস টেইলার্সে চাকুরী নিয়ে কাজ শুরু করি। উদ্দেশ্য শুধু চাকুরী করা নয়। নতুন ডিজাইনের কাজ শেখা ও পরিচিত হওয়ার স্বপ্নও ছিল ভিতরে ভিতরে। ইতোমধ্যে আমি একক প্রচেষ্টায় এইচএসচি পাশ করেছি। আমার একটি মেয়ে সন্তানেরও জন্ম হয়েছে। ২০০৮ সালে স্বামী আমাকে ছেড়ে স্থায়ীভাবে চলে যায়। আর ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে অবশেষে আমি তাঁকে তালাক দেই। এদিকে আমি যে টেইলার্সে চাকুরি শুরু করেছিলাম সেখানে ততদিনে আমার পদোন্নতি হয়েছে। আমি ঐ দোকানের ম্যানেজার হয়েছি। টেইলার্সটির মালিক আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে আমার নামে অবৈধ্য কাগজ পত্র তৈরি করে বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে যৌথ ভাবে বাড়ি বানানোর নামে ২২ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ করে। যার সকল দায় এসে পড়ে আমার উপর। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন ভাবে বিচার ও সালিসের মাধ্যমে সে দায় থেকে আমি মুক্তি পেলেও ঐ দোকান মালিক আমাকে চাকুরিচ্যুত করে তাড়িয়ে দেন।

এরপর আমি নিজের ও ২টি সন্তানের জীবন বাঁচাতে নতুন যুদ্ধে নামলাম। এক পর্যায়ে ২০১৪ সালে নিজের গচ্ছিত কিছু টাকা দিয়ে কাউলা বাজারেই শুরু করলাম আমার নিজের ব্যবসা 'নাজ টেইলার্স এন্ড ফেব্রিক্স'। ইতোপূর্বে যে টেইলার্সটিতে আমি কাজ করতাম তার কাছাকাছি একটি দোকান ভাড়া নেই, যার ভাড়া ৮ হাজার ও অগ্রীম ২ লক্ষ টাকা। দোকানের অগ্রীম বাবদ খরচ, ডেকোরেশন, মেশিন ইত্যাদি খরচের পর দোকানে কাপড় তোলার মতো যথেষ্ট পুঁজি আমার ছিল না। তাই তখন আমার ব্যবসার অবস্থা খুব ভাল চলছিল না। কারণ শুধু কাপড় সেলাই করে ব্যবসা জমানো খুব কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিল। ফলে আমি ব্যাংক ঋণের কথা ভাবতে থাকি। এরপর কয়েকটি ব্যাংকে ধরণা দিয়েও আমি ঋণ পাইনি। কারণ ঋণ পেতে যে সকল কাগজপত্রের প্রয়োজন হয় তা আমার ছিল না। তখন হঠাৎ আমার মাথায় আসে ডিএমসিবি’র কথা। কারণ আমি পূর্বে যে দোকানটিতে কাজ করতাম সে দোকানটিতে ডিএমসিবি’র বিনিয়োগ চালু ছিল। তাই আমি একদিন সরাসরি ডিএমসিবি’র এয়ারপোর্ট শাখাতে গিয়ে শাখা ব্যবস্থাপকের সাথে দেখা করি। আমি পূর্বের টেইলার্স-এর ম্যানেজার হওয়াতে শাখা ব্যবস্থাপক আমাকে চিনে ফেলেন। আমি তাকে আমার বর্তমান অবস্থা সব খুলে বলি। তিনি সব শুনে আমাকে বিনিয়োগ প্রদান করতে আশ্বাস দিলেন এবং আমার দোকান পরিদর্শন করে আমাকে ডিএমসিবি’র সদস্য হতে বলেন। তাঁর কথামত আমি ডিএমসিবি’র সদস্য হই এবং তিনি আমাকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগ প্রকল্পের আওতায় সহজ শর্তে প্রথমে ৫০ হাজার টাকা বিনিয়োগ প্রদান করেন। আমি কিস্তির মাধ্যমে খুব সহজেই নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করতে সক্ষম হই। প্রথম বিনিয়োগ পরিশোধের পর পুনরায় ১ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করি। ব্যস, আমার ভাগ্যের চাকায় লাগে নতুন গতি। আমি আমার ব্যবসাকে নিয়ে নতুন উদ্যমে পথ চলতে শরু করি। দোকানে নতুন কাপড় তোলার ফলে প্রচুর ক্রেতা আসতে শুরু করে। আর মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই আমার ব্যবসা দারুণ জমে উঠে। এই ব্যবসা একই স্থানে ৫ বছর ধরে চলতে থাকে। এদিকে আমাকে বিতাড়িত করা ঐ পুরাতন দোকানটির পূর্বের মালিক দোকানটি আর চালাতে পারছিলেন না। কারণ ততদিনে তার ব্যবসার সুনাম হারিয়ে তলানিতে এসে দাঁড়িয়েছে। মার্কেট মালিককে ঠিক মতো দোকান ভাড়াও দিতে পারেন না। তাই মার্কেট মালিক তাকে দোকান ছেড়ে দিতে বলে এবং আমাকে বলেন দোকানটি নেওয়ার জন্য। আমি সব শুনে একটি মুহুর্ত দেরী না করে রাজি হয়ে যাই দোকানটি নিতে। কারণ দোকানটির পজিশন আমার তখনকার দোকান থেকেও বেশ ভাল ছিল। তাছাড়া কেন জানি না ঐ দোকানটির সাথে আমার অন্যরকম একটি আত্মিক টান ছিল।

২০১৯ সালে তাই আমি আমার তখনকার দোকানের মেয়াদান্তে এই দোকানটি ভাড়া নেই। এই দোকানটি নিয়ে আমি অন্যরকম এক প্রশান্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। কারণ বিনা দোষে আমাকে এই দোকান হতে বিতাড়িত করা হয়েছিল। বর্তমানের এই দোকানটি ২২০ স্কয়ার ফুটের। দোকানটির ভাড়া ১০ হাজার টাকা, ভাড়া নেওয়ার সময় ৫ লক্ষ টাকার মালামাল/ফার্ণিচার, অগ্রীম ২ লক্ষ সহ মোট ৭ লক্ষ টাকা দিয়ে আমি দোকানটি বুঝে নেই। এই দোকানটি নেওয়ার সময়ও ডিএমসিবি আবারও আমার পাশে দাঁড়ায়। এখন পর্যন্ত ডিএমসিবি থেকে আমি ৮ বার বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি এবং সময় মতো তা পরিশোধও করেছি। বর্তমানে আমার চলমান বিনিয়োগটি ৫ লক্ষ টাকার। বর্তমানে আমার ব্যবসার অবস্থা আল্লাহর রহমতে দারুণ রমরমা। একটি দোকান থেকে আমি আরো একটি দোকান ও একটি কারখানা স্থাপন করেছি। দোকানে ৬ জন কর্মচারীর কর্ম সংস্থান করতে পেরেছি। আমার ব্যবসায় বর্তমানে ৩৫ লক্ষ টাকার মূলধন রয়েছে। বর্তমনে কাউলা বাজারে আমি একজন প্রতিষ্ঠিত সফল ব্যবসায়ী। ইতোমধ্যে আমি আমার দোকানের আয় থেকে আমার বড় ছেলেকে শান্তা মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেক্ট ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করিয়েছি, বর্তমানে সে একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করছে এবং মেয়ে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে। সারাটি জীবন ধরে আমি ভেসে বেড়িয়েছি। ভেসে বেড়াতে গিয়ে হাতের কাছে খড় কুটো যা পেয়েছি তাই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি। কিন্তু সব কিছুর দ্বারাই প্রতারিত হয়েছি। শুধু মাত্র ডিএমসিবি আমাকে বিশ্বাস করে মাথার উপর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চাকুরি নেই, স্বামী পরিত্যক্তা একজন নারীর উপর বিশ্বাস রেখেছিল ডিএমসিবি। তাই আমি আমৃত্যু এ প্রতিষ্ঠানটির কথা মনে রাখব।
সারা জীবনে পাওয়া কষ্ট থেকে শেখা একটি বিষয় আমি মানসিকভাবে স্থীর করে নিয়েছি যে, আমি আমার এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজের অসহায়, নিরুপায়, স্বামী পরিত্যক্তা ও বিধবা নারীদের পাশে দাঁড়াব। তাদেরকে আমার এই কাজ শিখিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সহযোগিতা করব। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, ডিএমসিবিও তাদেরকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসবে, ঠিক যেমন আমার অসহায় সময়ে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল"।