Total Visitor
Website counter
Counting since March 26, 2008

Success Story of Member

Client Image

শাখার নাম : নওয়াপাড়া শাখা, যশোর
কোড নং : ৬৭
ডিএমসিবি'র সহায়তায় জীবন সংগ্রামে জয়ী একজন সফল নারী উদ্যোক্তা অঞ্জু সরকার


" দি ঢাকা মর্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড " (ডিএমসিবি) এর আর্থিক সহায়তায় অঞ্জু সরকার কিভাবে ব্যবসায় সফলতা লাভের মাধ্যমে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন আমরা আজ তার সে কাহিনী ও গল্প শোনাব। সততা, কর্ম, উদ্যোম, উদ্যোগ এর মাধ্যমে মানুষ তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে তার বাস্তবাতার এক নিদর্শন অঞ্জু সরকার। যশোর জেলার অর্ন্তগত কেশবপুর থানার মূল গ্রামে বাংলার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের স্মৃতি বিজড়িত কপোতাক্ষ নদের তীরে ছোট্ট একটি কুঠিরে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করতেন অঞ্জু সরকার। তেমন কোন জায়গা জমি ছিল না। মাত্র ২ শতক বসত ভিটা ছিল। সেখানেই বসবাস করতেন অঞ্জু সরকার। স্বামী পরের জমিতে কাজ করতেন এবং বিকালে রিক্শা-ভ্যান চালাতেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস একদিন অঞ্জু সরকারের স্বামী খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সেই অসুখে তার শরীরের এক সাইড প্যারালাইসড হয়ে গেল, কোন কাজ কর্ম করতে পারতেন না। অঞ্জু সরকার দুই ছেলে স্বামী নিয়ে কি করবেন কিছু কূল কিনারা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তেমন কোন লেখাপড়াও জানেন না যে, কোন একটা চাকুরী করবেন। ক্ষুধার যন্ত্রণা, অভাবের তাড়নায় তিনি বাধ্য হয়ে পরের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ নিলেন এবং নিজের ছেলেকে অন্যের দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজে দিলেন। শুরু হল তার জীবন যুদ্ধের কূল কিনারাহীন পথচলা। যার শুরু ছিল, কিন্তু কোথায় শেষ হবে তার কোন ধারণা ছিল না। প্রথমে তিনি দুইটা বাড়িতে কাজ নেন। তিন বেলা খাওয়া আর সামান্য কিছু বেতন। সারাদিন মানুষের বাড়িতে কাজ করে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মন নিয়ে বাড়িতে ফিরতেন। বাড়িতে এসে আবার অসুস্থ স্বামীর দেখাশোনা করা, সংসারের কাজকর্ম করা। জীবনে এতটুকুও সুখ নেই।

অঞ্জু বলেন; এভাবে কয়েক বছর কাজ করার পর চিন্তা করলাম এভাবে মানুষের বাড়িতে আর কত দিন কাজ করব, নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য কিছু করার দরকার। বাড়ীর সকলে মিলে পরামর্শ করলাম যে, ছেলে যে টাকা বেতন পায় সেই টাকা সম্পূর্ণ সঞ্চয় করব, তাতে সংসারে যতই কষ্ট হোক না কেন। ২ বছর পর ছেলের সঞ্চয়কৃত টাকা এবং সেই সাথে আমারও কিছু সঞ্চয়ের টাকা মিলে ১৫ হাজার টাকার মত হলো। সেই টাকা নিয়ে পরিবারের সবাই চলে গেলাম ভারতে। ভারতে যেয়ে আরও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হলাম। বাংলাদেশী বলে কেউ আমাদেরকে ভাল ভাবে নিল না। কাজের জন্য সেখানেই যাই সেখান থেকে ফিরে আসি, কেউ কাজ দেয় না। অনেক কষ্টে একটা ফুলের দোকানে দৈনিক শ্রমিকের কাজ পাই। অনেক সময় না খেয়ে জীবন যাপন করেছি। সেখানে কয়েক বছর থাকলেও তেমন কিছু করতে পারি নাই। পরবর্তিতে আবার দেশে ফিরে এলাম। তখন হাতে কিছু টাকা ছিল।

মনে মনে চিন্তা করি এত অল্প টাকা দিয়ে কি ব্যবসা করব। তখন হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি আসে কেশবপুর বাজারে কেউ ফুলের ব্যবসা করে না। ভারতে থাকার সময় ফুল গাছ রোপন, পরিচর্যা এবং ফুল দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সাজানো এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। ভাবলাম যদি সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কেশবপুরেই ফুলের ব্যবসা করি তাহলে কেমন হয়। লক্ষ্য স্থীর করলাম আমি ফুলের ব্যবসা করব। দোকান ভাড়া নেওয়ার মত টাকা নাই তাই ভাবলাম এই টাকা দিয়ে ফুল কিনে রাস্তার ফুটপাথে বসে বিক্রি করব। পাশ্ববর্তী যশোরের গদখালী নামক এলাকা থেকে ফুল কিনে বিক্রি শুরু করলাম। কয়েক মাস ফুল বিক্রি করার পর মোটামুটি ভালই লাভ হল। ঐ লাভের টাকা দিয়ে ছোট্ট একটা দোকান ভাড়া নিলাম। কিন্তু পুঁজির অভাবে আর তেমন ফুল কিনতে পারি না। স্থানীয় এক এনজিও থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিলাম। এরপর অনেক কষ্ট করে একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান হতে আরো ১ লক্ষ টাকার ঋণ গ্রহণ করি। এর ফলে ব্যবসা কিছুটা দাঁড় করাতে সক্ষম হই। দোকনে তখন কিছুটা ভাল অবস্থানে আসে। নিয়মিতভাবে উক্ত ঋণের টাকা পরিশোধ করি। এরপর একদিন আর্শীবাদ স্বরূপ ডিএমসিবি’র নেয়াপাড়া শাখার বিনিয়োগ কর্মকর্তা শফিকুজ্জামান ভাই আমার দোকানে আসেন এবং পরিচয় বিনিময় হয়। পরিচয়ের এক পর্যায়ে জানতে পারি জন্ম সূত্রে তিনি আমার বাবার বাড়ি এলাকার লোক। এরপর কয়েকদিন পরপর তিনি আমার দোকানে আসতেন এবং ব্যবসার খোঁজ খবর নিতেন। কিছু দিন পর বিনিয়োগ নেওয়ার জন্য আমাকে প্রস্তাব দেন। আমি তখন তাকে বলি ভাই যদি আমাকে ২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ দেন তাহলে আমি ব্যবসাটা ভালভাবে করতে পারব।

এরপর একদিন তিনি শাখার ব্যবস্থাপককে নিয়ে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আসেন এবং আমার সার্বিক দিক বিবেচনা করে এবং ডিএসিবি’র সকল নিয়ম মেনে প্রথম বারে আমাকে ২ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ প্রদান করেন। টাকাটা হাতে পাওয়ার পর নিজের মনের ভিতর একটা প্রতিজ্ঞা আসলো, জীবনে সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে হলেও এই টাকার দ্বারাই আমি আমার ব্যবসার উন্নতি ঘটাব।

তবে একটা কথা না বললেই নয়, তা হলো আমার ধারণাই ছিল না যে, ডিএমসিবি আমাকে এতো সহজ শর্তে এত অল্প সময়ে বিনিয়োগ প্রদান করবে। যখন আমার পাশে সাহায্য করার মত কেউ ছিল না তখন আমার পাশে সহযোগিতার হাত বাড়ায় ডিএমসিবি’র নওয়াপাড়া শাখা। দোকানে গ্রাহকের চাহিদামত প্রযোজনীয় ফুল দিতে পারছিলাম না, ঠিকমত ব্যবসা করতে পারছিলাম না। বিনিয়োগ গ্রহণের জন্য অনেক ব্যাংকের নিকট যাই, কিন্তু কোন আশানুরূপ সাড়া পাইনি। জামানত বিহীন কোন ব্যাংক বিনিয়োগ দেয় নাই। কিন্তু কোন রকম হয়রানি এবং জামানত ছাড়ায় ডিএমসিবি আমাকে ২ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ প্রদান করেন যা আমার ভাবতে অবাক লাগে। এই টাকা পেয়ে আমি জীবনে নতুন ভাবে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। প্রচুর ফুল ক্রয় করি এবং দোকোনে মালামালে পরিপূর্ণ করি। এরপর এক পর্যায়ে ২ বিঘা জমি বর্গা নেই ফুল চাষের জন্য। প্রতিদিন বিক্রয়কৃত লাভের অংশ থেকে কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে থাকি ফলে কিস্তি পরিশোধে আমার কোন সমস্যাই হয় নাই। কয়েক মাস যেতে না যেতেই আমার চাষকৃত জমিতে ফুল ফোটা শুরু করল। বিভিন্ন এলাকা থেকে ফুল ব্যবসায়ীরা ফুল নিতে আসে এবং আমার লাভের অংশ অনেক বেড়ে যায়।

এরপর ডিএমসিবি'র ২ লক্ষ টাকা পরিশোধ করে আবার ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করি। এই টাকা পেয়ে আমি একটা পুরাতন পিকআপ ভ্যান ক্রয় করি। ঐ পিকআপ ভ্যান ক্রয় করার পর আমার ভাগ্যের চাকা আরও প্রসারিত হল। নিজের বর্গা নেয়া জমির উৎপাদিত ফুল বিভিন্ন উপজেলা, জেলায় বিক্রি করা শুরু করলাম। ডিএমসিবি’র ৩ লক্ষ টাকা পরিশোধ হওয়ার পর আবারও ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করলাম। এবার এই টাকা পেয়ে আমি চিন্তা করলাম, বর্তমানে আমার ব্যবসায় যে মূলধন আছে আমি ভালোভাবে চলতে পারব তাই বিনিয়োগের টাকা দিয়ে ফুল চাষের জন্য ১ বিঘা জমি ক্রয় করলাম। সেখানে রজনীগন্ধা এবং গোলাপ ফুলের চাষ শুরু করলাম। ফুল চাষে আমি ব্যাপক সাফল্য পেলাম। এলাকার মানুষের কাছে ফুল বৌদি হিসেবে পরিচিত হলাম। ফুল চাষ এবং ফুল বিক্রেতা হিসেবে আমার ব্যাপক প্রসার ঘটল। সমাজের সবাই আমার কাজের উৎসাহ দেখে প্রশংসা করতে লাগলো। প্রশংসার ফলে কাজের আগ্রহ ও অনুপ্রেরণা আরও বেড়ে গেল।

লাভের অংশ থেকে নিয়মিত কিস্তি দিয়ে বিনিয়োগের টাকা পরিশোধ করলাম। বিনিয়োগ নেয়া বন্ধ না করে পুনরায় ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করি। ঐ টাকা দিয়ে আমি আবার একটা পিকআপ ভ্যান ক্রয় করি। এবার পিকআপ ভ্যান গাড়িতে করে ফুল বিভিন্ন জেলায় ও ঢাকা শহরের পাইকারদের কাছে বিক্রি করতে শুরু করি। লাভের পরিমান অনেক বেড়ে গেল। এরপরের বারের টাকা দিয়ে আমি ১টি পুরাতন প্রাইভেট কার ক্রয় করি। উক্ত প্রাইভেট কার বিভিন্ন বিবাহ, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে ভাড়া দিতে থাকি।

মাঝে মাঝে মনে হয় রাজপরীর গল্পের মত আমার জীবন পরিবর্তন হয়ে গেল। এখন আমার ২টা ট্রাক এবং ১টা প্রাইভেট কার আছে, বাড়ি আছে, জমি আছে। কখনো ভাবতে পারি নাই কপোতাক্ষ নদের পাড়ে আমি একটা সুন্দর বাড়ী করতে পারব। বিধাতার কৃপায় তা করতে সক্ষম হয়েছি। বর্তমানে ৮ বিঘা জমিতে আমার ফুল চাষ আছে। আমার দোকানে এখন ফুলে পরিপূর্ণ। ৮ জন কর্মচারী আমার দোকানে কাজ করে। বিক্রি যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তেমনি লাভের পরিমান বৃদ্ধি পেয়েছে। আমার সংসারে কোন অভাব নেই। আমি স্বামী সন্তান নিয়ে বিধাতার কৃপায় ভাল আছি। আজ আমি একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। বর্তমানে ব্যবসা আরও সম্প্রসারণের জন্য ডিএমসিবি হতে আবারও ৩ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি। ডিএমসিবি'র নিকট আমি চির কৃতজ্ঞ, একজন নারী হয়েও আমার আর্থ-সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নতি ও আমার ব্যবসাকে সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে সহজ শর্তে বিনিয়োগ প্রদানের করার জন্য। আমি ডিএমসিব'র সার্বিক মঙ্গল কামনা করি এবং বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি ব্যাংকটি আরও সমৃদ্ধি ও উত্তরোত্তর উন্নতি লাভ করুক। পরিশেষে এ কথা বলতে চাই যে, মেঘ দেখে কেউ করিস না ভয়, আড়ালে তার সূর্য লুকিয়ে রয়। রাত যতই গভীর হোক না কেন অন্ধকার কেটে দিনের সূর্য উদয় হবেই। আর তার উজ্জ¦ল দৃষ্টান্ত আজ আমি অঞ্জু সরকার। ডিএমসিবি’র আর্থিক সহযোগিতা পেয়ে আমি আমার জীবনকে সুন্দর এবং সার্থক করে তুলতে পেরেছি।