Total Visitor
Website counter
Counting since March 26, 2008

Success Story of Member

Client Image

শাখার নাম : জামালপুর শাখা
কোড নং : ৬১
বদলে যাওয়া জামালপুরের সফল ব্যবসায়ী দেলোয়ার হোসেন


দোকানের গদিঘরে বসে জামালপুর শহরের সকাল বাজারের কোলাহলের মাঝেই নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাঁচা মাল কিনতে আসা ক্রেতাদের সাথে লেনদেনের হিসাব মেলাতে গভীর ভাবে মগ্ন ছিলেন মোঃ দেলোয়ার হোসেন দেলু। কোন দিকে তাকাবার ফুরসত নেই তার। প্রতিটি মালের হিসাব মিলানো আর সুনিপুন দক্ষতায় হিসাবযন্ত্রে আঙ্গুল বুলিয়ে হিসাবের অংক মেলাচ্ছিলেন মোঃ দেলোয়ার হোসেন দেলু। অসাধারন সে দৃশ্য। প্রবেশ দ্বারেই সালামের বিনিময়ে চোখের দিকে তাকাতেই একরাশ প্রাণবন্ত হাসিতে আমাদের স্বাগত জানালেন আর ব্যস্ত হয়ে পড়লেন "দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড" (ডিএমসিবি) এর জামালপুর শাখার ব্যবস্থাপক কে বসবার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য। আন্তরিকতা দেখে মনে হলো কতদিন পর তিনি তার কত আপনজনকে কাছে পেয়েছেন। সে আর কেউ নয়; কথা বলছিলাম প্রাণবন্ত, কর্মঠ এক সফল ব্যবসায়ী মোঃ দেলোয়ার হোসেন দেলু'র কথা। তিনি ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার একজন সন্মানিত সদস্য ও একাধিকবার বিনিয়োগ গ্রহীতা। তার সাথে আলাপ হয় জামালপুর জেলা শহরের সকাল বাজারস্থ তার নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কাঁচা মালের আড়ৎ 'মেসার্স দেলোয়ার ট্রেডার্স' এ বসে।

আজকের এই মেসার্স দেলোয়ার ট্রেডার্স দাঁড় করাতে অনেক কষ্ট ও মেহনত করতে হয়েছে তাকে। জীবনের শৈশবে যেখানে অন্য শিশুরা খেলাধুলায় মগ্ন থাকতো সেই সময় থেকেই তাকে জীবিকার প্রয়োজনে কাজে নামতে হয়। আজকের এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করার যে সফলতা তার পুরো কৃতিত্বটাই ডিএমসিবি’র আর্থিক সহযোগিতায় তা তিনি কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন । ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার আর্থিক সহযোগিতাই তাকে আজ এক সফল কাঁচামাল ব্যবসায়ীর সন্মান এনে দিয়েছে। শৈশব থেকে আজকের অবস্থানের কথা বলতে গিয়ে মোঃ দেলোয়ার হোসেন দেলু বলেন, জামালপুর সদরের শরিফপুর ইউনিয়নে জয়রামপুর গ্রামের এক অসচ্ছল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। বাবা হাফেজ উদ্দিন আর মাতা বিবিতন বেগমের সংসারে তারা ৬ ভাই এর মধ্যে তিনি ছিলেন ৫ নম্বর। বাবা কৃষি কাজ করে কোন রকমে সংসার চালাত । শৈশব পার হতে না হতেই ৫ম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় বাবার মৃত্যুর পর যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো তার মাথার উপর। এত বড় সংসার চালাতে তার মা বিবিতন অন্যের বাড়িতে ঝিঁ এর কাজ করে যত সামান্য যা পেতো তা দিয়ে কোন রকমে খেয়ে না খেয়ে চলতো তাদের। এভাবে আর কতদিন। আর পড়ালেখার টাকা জোগাড় করতে না পারায় পঞ্চমেই ইতি টানতে হলো পড়ালেখার। শৈশব ছেড়ে সবে মাত্র কৈশরে পা দিতেই জীবিকার সন্ধানে আর পেট ভরে দু’মুঠো ভাত পেতে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে মাত্র ৩০০ টাকা বেতনে এক কাঁচা মালের দোকানে চাকুরি শুরু করেন তিনি। এভাবে চলতে থাকে আরো ৩ বছর। তারপর সেখান থেকে ৬০০ টাকা বেতনে রাজধানী মার্কেটের এক ফার্ণিচারের দোকানে চাকুরী হয়। সেখানেও বছর দুয়েক থাকার পর টিকাটুলির একটি গার্মেন্টস এ ৯০০ টাকা বেতনে চাকুরী শুরু করেন তিনি। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য সেখান থেকেও চলে আসে সে। এভাবে কিছুদিন চলার পর নিজ গ্রামের বাড়ি এসে দোলোয়ার হোসেন জামালপুর শহরের ভোকেশনাল মোড়ে নাজিম উদ্দিন হাজী সাহেবের বাসায় দেড় হাজার টাকা বেতনে বাড়ীর কাজের লোকের চাকুরি নেয়। এভাবে আরো কিছুদিন চাকুরী করার পর নিজ গ্রামের বাড়ী শরিফপুরে চলে যায় সে। সেখানে নিজের পায়ে দাঁড়াতে ভাড়ায় রিকসা চালানো শুরু করে। এভাবে ৮ মাস রিকসা চালিয়ে তা থেকে কিছু সঞ্চয় করে ৪ হাজার টাকা জমায় সে। পরিচয় হয় নান্দিনা বাজারের এক কাঁচামাল ব্যবসায়ীর সাথে। আদা, রসুন, পিয়াজ আলু বিভিন্ন বাজার থেকে এনে তা বিক্রি করে। পরবর্তীতে সেই ব্যবসায়ীর সাথে লভাংশ অর্ধেক ভাগাভাগির শর্তে ব্যবসা শুরু করে। সেখানে পুঁজি কম থাকায় ব্যবসায় তেমন লাভ না হওয়ায় অনেকটা হাতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ে সে। কিন্তু জীবনে পিছু হটার ছেলে সে নয়।

ইতোমধ্যেই তার দুই ভাই আব্দুর রহিম ও মানিক মৃত্যু বরণ করে। তাদের দুই জনের সংসারের ছেলে-মেয়েদের দেখাশুনার দায়িত্ব পড়ে দোলোয়ারের উপরেই। কিন্তু তার এই সামান্য আয় দিয়ে তো আর সংসার চালানো যাবে না। শুরু হয় নতুন কিছু করার পরিকল্পনা। কিন্তু মূলধন কোথা থেকে আসবে। ইতোমধ্যেই সে জামালপুর শহরের সকাল বাজারে আলু, আদা, রসুন, পিঁয়াজ এর পাইকারী ব্যবসা শুরু করেন। দেলোয়ার এর ব্যবসার প্রতি আগ্রহ আর সততা দেখে সকাল বাজারের মজিবুর রহমান তাকে শেয়ারে ব্যবসা করতে বলে। পরে তার সাথে কিছুদিন ব্যবসা পরিচালনা করতে থাকলে মোটামোটি কিছু মূলধন হয়। এ সময় তার পরিচয় হয় একই বাজরের সবজী ব্যবসায়ী আব্দুল কুদ্দস এর সাথে। সে তার সাথে ব্যবসা করতে বলে। এভাবে কুদ্দস এর মূলধন আর দোলোয়ারের সামান্য পুঁজি দিয়ে জয়পুরহাট, পাবনা, রংপুর ও দিনাজপুর জেলা থেকে কাঁচামাল এনে ব্যবসা করতে থাকেন। তবে বেশ কিছুদিন চলার পর একবার নতুন আলুর ট্রাক দুদিন উত্তর বঙ্গে আটকে থাকার ফলে সময় মত পাইকারদের কাছে পৌঁছাতে না পারায় যে আলুর দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি ছিল সেই আলু মাত্র ১৫ থেকে ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়। এতে ঐ চালানে ৮ লাখ টাকা লোকসান হয়ে তারা আরো প্রায় ৪ লাখ টাকার মত ঋণে পড়ে যায়। এই লোকসানের পর কুদ্দুসের সাথে চলা কাঁচা মালের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হয় তার। এরপর চোখে মুখে শুধু অন্ধকার দেখে সে। কি করবে, সংসারই বা চলবে কিভাবে। ব্যবসা করতে যে মূলধন লাগে তাই বা কে দিবে তাকে। নানা চিন্তায় ঘুম আসে না তার। এগিকে সে কিছুদিন পূর্বে বিয়ে করে এক কন্যা সন্তানেরর বাবাও হয়েছে। কিভাবে চলবে তার সংসার। নানা চিন্তা তার মাথায় আসে। পরিকল্পনা করে, যে করেই হোক সকাল বাজারেই দোকান নিতে হবে। শুরু করতে হবে তার নিজের ব্যবসা। কিন্তু তার জন্য তো দোকান ঘর ও মুলধন দরকার। তার এসব কথা শুনে এক বন্ধু তাকে ৫০ হাজার টাকা ধার দেন। সেই টাকা নিয়ে অনেক কষ্টে জামালপুর পৌরসভার তৎকালিন মেয়রের কাছে অনেক অনুনয় বিনয় করে সকাল বাজারে ১০ হাজার টাকা জামানত ও মাসিক ১ হাজার টাকা ভাড়ায় একটি দোকান ঘর বরাদ্দ পায় সে। কিন্তু বিধি বাম। তাতেও সাবেক কাঁচা মালের আড়ৎ মালিক ও স্থানীয় কাউন্সিলরের বাধা চরম আকার ধারণ করে। কোন ভাবেই এখানে কোন দোকান করতে দেওয়া হবে না তাকে। তবে এত সহজে হার মানতে নারাজ সে। পরে বাজারের গণ্যমান্যদের সহায়তায় তাদের কোন মতে বুঝিয়ে হাতে থাকা বাকী ৩৯ হাজার টাকা দিয়েই শুরু হয় কাঁচা মালের আড়ৎ নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স দেলোয়ার ট্রেডার্স। নিষ্ঠা, সততা আর কঠোর পরিশ্রমই সাফল্য আনবে একদিন এমন বিশ^াস থেকে দেলোয়ার নিজেকে প্রস্তুত করতে থাকে। তবে এক সময় চিন্তা করতে থাকে যে যদি ব্যবসায় আরো পুঁজি বিনিয়োগ করা যেত তাহালে আরো লাভ হতো। কিন্তু পুঁজি কিভাবে পাবো, তা ভেবে পাচ্ছিল না সে। এমনি ভাবে চলতে থাকলে একদিন সকাল বেলায় তার কাঁচা মালের আড়ৎ এ এসে একজন সালাম দিয়ে বলে যে, সে ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার একজন বিনিয়োগ কর্মকর্তা, নাম আব্দুর রউফ। তিনি আরও জানান যে, দৈনিক বেঁচা-কেনা আছে, যারা সৎ ও কর্মঠ এমন সব ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসার ধরণ দেখে ডিএমসিবি সহজ শর্তে বিনিয়োগ প্রদান করে। কথাটি শুনে দেলোয়ার এর অনেক ভালো লাগলো। সে জানতো ব্যাংকের বিনিয়োগ নিতে গেলে জমি সহ অন্যান্য কিছু জামানত হিসেবে রাখতে হয়। কোথায় পাবে সে জামানত। জামানত না থাকার কারণে সে বিনিয়োগের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাতে পারছিল না। তবে তার সাথে কথার একপর্যায়ে দেলোয়ার জানতে পারলো যে ডিএমসিবি সহজ শর্তে, স্বল্প সময়ে কোন প্রকার জামানত ছাড়াই বিনিয়োগ দিয়ে থাকে। তখন সে আগ্রহ প্রকাশ করলো যে, সে কিভাবে এই বিনিয়োগ পেতে পারে। এরপর সেই বিনিয়োগ কর্মকর্তা তাকে আরও বিস্তারিত জানতে ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার ব্যবস্থাপকের কাছে আসতে বলে।

পরদিন সকালে তার এক বন্ধুকে নিয়ে ডিএমসিবি জামালপুর শাখার ব্যবস্থাপকের কাছে হাজির হয় দেলোয়ার। শাখা ব্যবস্থাপকের ব্যবহারে সন্তোস প্রকাশ করে তার ব্যবসার ধরণ ও পরিকল্পনা শুনে তাকে ডিএমসিবি'র সদস্য হতে বলে। শাখা ব্যবস্থাপকের কথা মত ডিএমসিবি'র সদস্য হয়ে সঞ্চয়ী হিসাব খুলে অল্প দিনের মধ্যেই ২০১১ সালে প্রথম দৈনিক ২৫০ টাকা কিস্তিতে ৫০ হাজার টাকার একটি বিনিয়োগ গ্রহণ করে সে। সেই বিনিয়োগের পুরো টাকা দিয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যবসায় বিনিয়োগ করার ফলে অল্প দিনেই ব্যবসায় উন্নতি হতে থাকে। আড়ৎ এ মালামাল বেশী হবার সুবাদে নতুন নতুন পাইকার বৃদ্ধির পায়। এতে করে ব্যবসা বেশী হবার ফলে লাভের পরিমানও বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। দেলোয়ার হোসেন ডিএমসিবি’র এই জামালপুর শাখা থেকে ১৫ বার বিনিয়োগ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে এই শাখা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকার বিনিয়োগ চলমান। আর নিজ হাতে ৫ লাখ টাকার মূলধন রয়েছে।

দেলোয়ার হোসেন দেলু আরও বলেন, ব্যবসার পাশাপাশি সাংসারিক জীবনে বর্তমানের ৩ কন্যা সন্তানের পিতা তিনি। নিজে লেখাপড়া না করতে পারলেও বড় মেয়ে একাদশ শ্রেণীতে , মেঝো মেয়ে ৩য় শ্রেণীতে ও অপরজন এখনো অনেক ছোট। সেই সাথে মৃত দুই ভাই রহিম ও মানিকের ছেলে মেয়েদেরও পড়ালেখার খরচ চালিয়ে নিচ্ছে দেলোয়ার হোসেন। এই ব্যবসা থেকেই সে নিজ গ্রামের বাড়িতে একটি ২০ হাত লম্বা চৈড়ি ঘর দিয়েছে। ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখা ছাড়াও তার আরও দুটি ব্যাংকে হিসাব রয়েছে তার। তবে সেই ব্যাংকগুলো থেকে সে বিনিয়োগ গ্রহণ করেনি। কারণ তাদের বিনিয়োগ পাবার শর্ত ও সময় তার মন মত হয়নি।

দেলোয়ার হোসেন দেলু বলেন, বিনিয়োগের প্রয়োজন হলে আমার আড়ৎ এ আসা ডিএমসিবি’র বিনিয়োগ কর্মকর্তাকে বলি। অথবা ব্যবসায়িক কোন পরিকল্পনা থাকলে আমি ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার ব্যবস্থাপক এর কাছে পরামর্শ করে ব্যবসায় বিনিয়োগ করি। এই ব্যাংকটিকে আমি ব্যাংক না ভেবে আমার জীবনের পথপ্রদর্শক ও অবিভাবক মনে করি। শুন্য থেকে আজ আমি দেলোয়ার ট্রেডার্স এর স্বত্ত্বধিকারী সফল ব্যবসায়ী; যার পুরো কৃতিত্বটাই যায় ডিএমসিবি’র জামালপুর শাখার। ভবিষ্যতে আমার এই প্রতিষ্ঠানটির পাশাপাশি আরো বড় পরিসরে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর করার পরিকল্পনা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ডিএমসিবি’র সহযোগিতা কামনা করি।