Total Visitor
Website counter
Counting since March 26, 2008

Success Story of Member

Client Image

শাখার নাম : মিরপুর শাখা, ঢাকা
কোড নং : ১২
ঝড়ে ভেসে যাওয়া স্বপ্ন ও ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে ডিএমসিবি


মোঃ শামীম হাওলাদার, ক্রোকারিজ দোকানের সামান্য ৩ হাজার টাকা বেতনের একজন সাধারণ কর্মচারী হতে আজ প্রতিষ্ঠিত ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী। শুধু খুচরা বিক্রি নয় সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় ক্রোকারিজ দোকানে তার মালামাল পাইকারী বিক্রির ব্যবসা রয়েছে। বর্তমানে স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র নিয়ে তার সুখের সংসার। তার জীবনের বন্ধুর পথ পেরিয়ে কিভাবে এই সুখের দেখা পেলেন সেই সূত্র জানতে আমরা গিয়েছিলাম তার ঢাকাস্থ মিরপুর ১ নাম্বারের শাহ আলী শপিং কমপ্লেক্স এর আন্ডার গ্রাউন্ড ফ্লোরে অবস্থিত ক্রোকারিজ এর দোকান ‘সামিয়া এন্টারপ্রাইজ’ এ। মার্কেটের সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে হাতের বায়ে অবস্থিত আট বাই ষোল ফুটের দোকানটি অত্যন্ত পরিপাটি করে সাজানো গোছানো। আমরা “দি ঢাকা মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ ব্যাংক লিমিটেড” (ডিএমসিবি) থেকে তার দোকান পরিদর্শনে এসেছি জেনে তিনি দোকানের চেয়ার ছেড়ে আমাদেরকে রিসিভ করার জন্য এগিয়ে আসেন। এরপর আমাদের বসতে দিয়ে ব্যস্ত হলেন আপ্যায়ন করতে। আমরা তাকে ব্যস্ত না হওয়ার জন্য বলায় তিনি তার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। তারপর আমরা জানতে চাইলাম তার ব্যবসায়িক সাফল্যের কাহিনী।

শামীম হাওলাদার বলেন; সময়টা বেশ আগের তখন এই মিরপুরে আমাদের নিজেস্ব বাড়ি ছিল, ছিল বাবার রমরমা বাঁশের ব্যবসা। তখন আমি বেশ ছোট, আমার বয়স ৫/৬ বছর হবে। ঢাকার দিয়াবাড়ী ভেড়ী বাঁধে আমার বাবার তখন অনেক বড় বাঁশের ব্যবসা ছিল। তখনকার দিনে বাবা ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। বাবা সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঁশ ক্রয় করে নদীপথে ভাসিয়ে তা নিয়ে আসতেন ঢাকার দিয়াবাড়ীতে। এ ভাবে ভালই চলছিল বাবার ব্যবসা। এর মধ্যে একটা সময় বাবার ব্যবসায় বেশ মন্দা যাচ্ছিল। বাবা তার ব্যবসার এই মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে তার সর্বস্ব বিনিয়োগ করেন এবং সেই সাথে অনেকগুলো টাকা ধার-দেনা করে চট্টগ্রাম থেকে অনেক বড় একটি বাঁশের চালান ক্রয় করেন। নদীপথে সেই বাঁশ নিয়ে লোক মারফত পাঠান ঢাকার উদ্দেশ্যে। আমার বাবার বিশ্বাস ছিল এই চালান বিক্রয় করে তিনি তার ব্যবসার মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারবেন, সেই সাথে সমস্ত ধার দেনাও পরিশোধ করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস মেনে নিতে হয়। বাবা এই বাশেঁর চালান ক্রয় করে নদী দিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে আসার পথে ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড় ও জলচ্ছ্বাসে বাঁশের সেই চালান খুলে রাতারাতি নদীতে ভেসে যায়। এর ফলে আমাদের পরিবার পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে যায়, বাবা হয়ে যায় কর্মহীন ও সহায় সম্বলহীন।

বাবা অনেক ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে আমাদের ঢাকার মিরপুরের বাড়ীটি বিক্রয় করে দিতে বাধ্য হন। আমরা ফিরে যাই আমাদের গ্রামের বাড়ী নারায়ণগঞ্জ সদরের সৈয়দপুরে। বাধ্য হয়ে আমাদের ৪ ভাই ও ১ বোনকে ঢাকার ভাল স্কুল ছেড়ে সৈয়দপুরে সরকারী ফ্রি স্কুলগুলোতে ভর্তি হতে হয়। বাড়ী বিক্রয়ের টাকা দিয়ে বাবা তার ব্যবসার যাবতীয় ঋণ পরিশোধ করেন। এরপর সামান্য যা টাকা হাতে অবশিষ্ট ছিল তা দিয়ে বাবা নতুন ভাবে ঢাকায় আবার বাঁশের ব্যবসা শুরু করেন। কিন্তু বাবা সারা জীবন চেষ্টা করেও তার সেই সামান্য পুঁজির খুঁড়িয়ে চলা ব্যবসাটা আর ভালোভাবে দাঁড় করাতে পারেননি। এরমধ্যে সংসারে অভাব প্রকট আকার ধারণ করে, কারণ আমার ভাইবোনরা বড় হচ্ছিলাম; ফলে আমাদের চাহিদাও ক্রমে বাড়ছিল।

এরপর বাধ্য হয়ে অষ্টম শ্রেণীতেই পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু রোডের জনতা সুপার মার্কেটে ১৯৯৮ সালে একটি ক্রোকারিজ এর দোকানে মাসিক ৩ হাজার টাকা বেতনে চাকুরি নিলাম। দোকানটির নাম ছিল পদ্মা ক্রোকারিজ। দোকানের মালিক আমাকে বেশ আদর করতেন। তাঁর কাছে চাকুরি করার সময়ই আমি স্বপ্ন দেখতাম অর্থনৈতিক মুক্তির। তাই সেখানে ২ বছর চাকুরি করার পর নিজের বেতন আর একটু বাড়াতে চলে আসলাম ঢাকায়। ঢাকায় এসে মিরপুরের ১ নাম্বারে বর্তমানে আমার দোকান যে মার্কেটে সেই মার্কেটে একটি ক্রোকারিজের দোকানেই চাকুরি নিলাম। দোকানটিতে আমার সাথে আরও একজন চাকুরি করতেন। আমি চাকুরি নেওয়ার ১ বছরের মাথায় দোকানের মালিক আমার সাথে চাকুরী করা ঐ দোকানে অন্য যে কর্মচারী তার কাছে বিক্রি করে দিয়ে দেশের বাহিরে চলে যায়। অগত্যা আমি আমার সাথে কাজ করা ঐ কর্মচারীর দোকানে যিনি তখন ঐ দোকানের মালিক হয়েছেন তার কাছে আরো ২ বছর চাকুরি করলাম। এরপর ঐ একই মার্কেটের অন্য একটি দোকানে টানা ১২ বছর চাকুরি করি। ইতোমধ্যে ২০০৯ সালে আমি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও বিবাহের পর থেকে আমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম যে নিজে ব্যবসা করবো। কিন্তু আমার কাছে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় কিছুতেই তা সম্ভব হচ্ছিল না।

এরপর ২০১৪ সালে আমি চাকুরি ছেড়ে নিজে ব্যবসা করার মনস্থির করলাম। দোকান হিসেবে পেয়ে গেলাম ঐ একই মার্কেটের সেই দোকানটি যেটিতে আমি ঢাকায় এসে প্রথমে চাকুরি শুরু করি সেটি আর তার পাশেরটি অর্থাৎ ২টি দোকান একসাথে। ততদিনে এই মার্কেটে আমার বেশ সুনাম ও পরিচিতি হয়ে গেছে। আর আমার সততা ও বিশ্বস্ততার জন্য যে দোকানের অগ্রীম ছিল ৫ লক্ষ টাকা তা আমি পেয়ে গেলাম মাত্র ২ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায়। দুটি দোকানের একত্রে ভাড়া ১৬ হাজার টাকা। পুঁজি বলতে নিজের চাকুরি করে জমানো ৪ লক্ষ টাকা আর নিজের বড় ভাবির কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা ধার হিসেবে পাই। যার অর্ধেকটা দিই অগ্রীম হিসেবে আর বাকি অর্ধেক দিয়ে দোকানের মালমাল তুলি। এরপর ডেকোরেশন সহ মালামাল ক্রয়ের পুঁজি কম পড়ায় পূণরায় স্ত্রীর গহনা বিক্রয় করে পুঁজি জোগাড় করি।

শুরু হলো আমার জীবনের নতুন অধ্যায়। শুরু হলো নতুন স্বপ্নের পথচলা। মোটামুটি ভালোভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু কিছুদিন না যেতেই আবারও শুরু হলো পুঁজির অভাব। কারণ ক্রোকারিজ ব্যবসায় অনেক পুঁজির প্রয়োজন। আমার সামান্য পুঁজির ব্যবসা ভালোভাবে পরিচালনা করা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে গেল। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ব্যাংক হতে ঋণ নেওয়ার, কিন্তু আমার মর্টগেজ দেওয়ার মতো তেমন কিছু না থাকায় আমি ব্যাংক হতে ঋণ গ্রহণে ব্যর্থ হলাম। পরে মিরপুর মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের আমার এক ব্যবসায়ী বন্ধুর মাধ্যমে আমি ডিএমসিবি’র কথা জানতে পারি এবং ডিএমসিবি হতে ঋণ গ্রহণে আগ্রহী হই। এরপর আমি একদিন আমার ঐ বন্ধুর মাধ্যেমে আমাদের মার্কেট এলাকার যিনি ডিএমসিবি’র বিনিয়োগ কর্মকর্তা তার সাথে কথা বলি। তিনি আমাকে বলেন আমি যেন মিরপুর শাখায় গিয়ে ব্যবস্থাপক স্যারের সাথে দেখা করি। আমি তার পরামর্শ অনুযায়ী একদিন মিরপুর শাখায় যাই। ব্যবস্থাপক স্যারের কাছে আমার ব্যবসার বর্তমান অবস্থা, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং বিনিয়োগ পেতে আগ্রহ প্রকাশ করি। ব্যবস্থাপক স্যার সব শুনে আমাকে ডিএমসিবি’র সদস্য হতে বলেন। আমি আর দেরি না করে পরের দিন প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র এনে সদস্য হয়ে ডিএমসিবি’র দুটি সঞ্চয় প্রকল্পে ডিএসপি ও এমএসপিতে টাকা জমাতে থাকি। এরমধ্যে একদিন ব্যবস্থাপক স্যার নিজে এসে আমার দোকান দেখে খুব সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন এবং পরের সপ্তাহে ডিএমসিবি থেকে আমাকে প্রথম বারের মতো ৫ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ প্রদান করেন। এই বিনিয়োগ পাওয়ার ফলে আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি যেন নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেল। আমি সম্পূর্ণ নতুন উদ্যোমে আমার ব্যবসা শুরু করলাম। আমার দোকানে বিক্রয় অনেক বেড়ে গেল এবং স্বাভাবিক ভাবে অধিক বিক্রীর ফলে আমার লাভও বেশ ভাল পরিমানে হতে থাকল। আর এই লাভের টাকা হতে আমি ডিএমসিবি হতে গ্রহণকৃত বিনিয়োগের টাকা প্রতিদিনের কিস্তিতে পরিশোধ করতে লাগলাম। এরপর আমাকে আর ব্যবসার জন্য পুঁজি নিয়ে ভাবতে হয়নি। যখনই পুঁজি দরকার তখনই ডিএমসিবি’র দারস্ত হয়েছি। প্রতিষ্ঠানটি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং চাহিদা মত বিনিয়োগ প্রদান করেছেন। ডিএমসিবি থেকে আমি এ পর্যন্ত ৫ বার বিনিয়োগ গ্রহণ করেছি। ডিএমসিবিতে আমার বর্তমান বিনিয়োগটি ৭ লক্ষ টাকার যা চলমান।

২০১৬ সালে আমি আমার দোকানের সামনের দিকের ২টি দোকান পেয়ে যাই এবং আমি ডিএমসিবি থেকে বিনিয়োগ নিয়ে দোকান দুটির মালিককে অগ্রীম হিসেবে প্রদান করি। সেই দোকান দুটিকে মাঝখান থেকে জোড়া দিয়ে আমি বর্তমানে আমার ব্যবসা পরিচালনা করছি। দোকান দুটির অগ্রীম বাবদ প্রদান করেছি ৫ লক্ষ টাকা ও মাসিক ভাড়া দিতে হয় ২০ হাজার টাকা। এছাড়া আমি আমার এই ব্যবসার টাকা দিয়ে গ্রামে একটি পাকা বাড়ী তৈরী করেছি। বর্তমানে আমি প্রায় ৩০ লক্ষ টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছি। স্ত্রী, কন্যা ও পুত্র নিয়ে আমার ৪ জনের সুখের সংসার। মা-বাবা বর্তমানে গ্রামেই থাকে। তাদেরকেও আমি আমার সাধ্যমতো সাহায্য করি।

আমার মেয়েটিকে ঢাকার একটি ভাল স্কুলে পড়াই। মেয়েটি ৫ম শ্রেণীর সমাপণী পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়েছে। বর্তমানে সে ৬ষ্ট শ্রেণীতে পড়ছে। আর ছেলেটি ছোট। এখনও স্কুলে যায় না। আমার দোকানে ২ জন কর্মচারী রয়েছে। তাদেরও পরিবার আমার এই দোকানের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে আমার দোকান থেকে দেশের বিভিন্ন জেলাতে পাইকারী মালামাল সরবরাহ করি। আমার ভবিষ্যতে ইচ্ছা আছে, আমি ভালো কিছু সিরামিক কোম্পানির এজেন্সি/ ডিস্টিবিউটারশিপ নিবো। সেই সাথে আর একটি গোডাউন ভাড়া নেব।

পরিশেষে বলতে চাই; আমি যখন ব্যবসা নিয়ে অসহায়ত্বের মধ্যে পড়ে ছিলাম তখন ডিএমসিবি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমাকে নিমর্জিত অন্ধকার থেকে টেনে তুলেছে। তাই মাঝে মাঝে ভাবি যে, ডিএমসিবি শুধু আমাকে নয়; আমার পরিবারকেও সেই ১৯৯১ সালের ঝড়ে ভেসে যাওয়া স্বপ্ন ও ভাগ্য ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি ডিএমসিবি’র সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামানা করি।